শব্দ নিয়ে ৭ টি মজার ঘটনা এবং তার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা

শব্দ নিয়ে ৭ টি চমকপ্রদ ঘটনা এবং তার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা
Image by Wisilife

শব্দ নিয়ে কম বেশি আমরা সবাই জানি। এমনকি বিজ্ঞান নিয়ে খুব সামান্য জ্ঞান যার আছে সেও শব্দ নিয়ে কোন না কোন চমৎকার ঘটনার ব্যাখ্যা দিতে পারবেন। তবে শব্দ নিয়ে কিছু চমৎকার ঘটনা আছে যা আমরা খুব কম মানুষই জানি। তো চলুন দেখকে নেওয়া যাক এমন কিছু ঘটনার এবং জেনে নেওয়া যাক সেসবের ব্যাখ্যা।


১। গ্রীষ্মকালে শব্দ অন্য সময়ের চেয়ে জোড়ে শোনা যায়।

স্বাভাবিক ভাবে গ্রীষ্মকালের সাথে শব্দের বেগের সম্পর্ক খোঁজা টা অহেতুক মনে হতে পারে। মনে হতে পারে যে এটি সম্পূর্নই একটি মানসিক ব্যাপার। কিন্তু না, শব্দ প্রকৃত অর্থেই গ্রীষ্মকালে সামান্য তীব্রতর হয়।

যদিও বিভিন্ন ঋতুতে শব্দের তীব্রতার পার্থক্য উপলব্ধি করা খুব কঠিন, তবে এটি সত্য যে গ্রীষ্মকালে অন্য ঋতুর চেয়ে শব্দ জোড়ে শোনা যায়। এর পেছনের কারন টি অবশ্য খুবই সহজবোধ্য।

অন্যান্য মৌসুমের তুলনায় গ্রীষ্মকালে তাপমাত্রা অনেক বেশি থাকে। ফলে বাতাসের কনাগুলো বেশি তাপমাত্রায় অন্যান্য সময়ের চেয়ে খুব দ্রুত কম্পন দেয়। অন্য ঋতুতে এই কম্পন তুলনামূলক কম থাকে।

মাধ্যমের কনাগুলোর এমন কম্পনের জন্য কণাগুলো শব্দ তরঙ্গ কে খুব দ্রুত সামনে অগ্রসর করে দেয়। এতে শব্দের বেগ বেড়ে যায় এবং শব্দ টি তুলনামূলক জোড়ে শোনা যায়। বায়ুর তাপমাত্রা প্রতি ১ ডিগ্রী সেলসিয়ায় বৃদ্ধির জন্য শব্দের বেগ ০.৬ মিটার/সেকেন্ড করে বৃদ্ধি পায়। অতএব, মাধ্যমের তাপমাত্রা যত বাড়বে শব্দের বেগ ও তত বৃদ্ধি পাবে।


২। মাছি কোন শব্দ শুনতে পায় না

হ্যাঁ, এটি শুনে আপনি হয়তো অবাক হবেন, তবে এটি সত্য। মাছি প্রজাতির বেশিরভাগই শুনতে পায় না। আপনি হয়তো লক্ষ্য করবেন মাথের ওপরে তাদের বড় বড় চোখ রয়েছে যা 360-ডিগ্রী ভিউ দেখতে সক্ষম। তারা খুবই দ্রুত এবং চালাক। তবে তারা যদি কোন শব্দই শুনতে না পারে তাহলে কীভাবে এত দ্রুত এবং চটপটে হয়েছে?

তারা কোনও শব্দ শুনতে পারে না, তবে তারা এটি অনুভব করতে পারে।

নিশ্চয়ই ইয়ার্কী মনে হচ্ছে? ঠিক আছে, চলুন দেখে নেওয়া যাক এর পেছনের বিজ্ঞান

শব্দ যে কোনও ধরনের কম্পন দ্বারা হতে পারে। তাদের মধ্যে কিছু আমরা শুনতে পারি এবং অন্যগুলো পারি না। কোন মাধ্যম থেকে উৎপন্ন হয়ে এটি মাধ্যমের ক্ষুদ্র কণাগুলি স্পন্দিত করে মাধ্যমের মধ্য দিয়ে ভ্রমণ করে এবং প্রক্রিয়াটি অব্যাহত রেখে সামনে অগ্রসর হতে থাকে। সুতরাং, যখন কোন শব্দ উৎপন্ন হয়, তখন এটি বাতাসের কণাগুলি স্পন্দিত করে বাতাসের মধ্য দিয়ে ভ্রমণ করে। মাছি শব্দের এই কম্পন নির্ণয় করতে পারে। ফলস্বরূপ, কিছু না শুনে তারা শব্দের উৎস সনাক্ত করতে পারে। আর এ কারনেই মাছি এত স্মার্ট হয়ে উঠেছে।


৩। তিমি মাছ অনেক দুর পর্যন্ত একে অন্যের সাথে যোগাযোগ করতে পারে

তিমিকে বিশ্বের বৃহত্তম প্রাণী হিসাবে বিবেচনা করা হয়। এরা সবচেয়ে বড় স্তন্যপায়ী প্রাণীও। তা ছাড়াও তাদের একটি বিশেষ ক্ষমতা রয়েছে। এরা দীর্ঘ দূরত্বে একে অপরের সাথে যোগাযোগের ক্ষমতা রাখে।

তিমির সৃষ্ট শব্দ তরঙ্গ সমুদ্রের জলের মধ্য দিয়ে প্রায় 479 মাইল পর্যন্ত ভ্রমণ করতে সক্ষম । পৃথিবীতে আর কোনও প্রাণী এটি করতে পারে না। তবে সমুদ্রের জলে আরও এমন প্রাণী রয়েছে যা একে অপরের সাথে দীর্ঘ দূরত্বে যোগাযোগ করতে পারে। এদের মধ্যে রয়েছে ডলফিন।


৪। বাদুড় শব্দের প্রতিদ্ধনি কাজে লাগিয়ে উড়ে বেড়ায়।

বাদুড়ের চোখ রয়েছে তবে তারা দেখতে পায় না। আমরা হরহামেশাই রাত বা সন্ধ্যার আকাশে এদের অবাধে উড়তে দেখি। দেখে মনে হয় যে তারা অন্যান্য পাখির মতো স্বাভাবিকভাবে চলাচল করতে পারে এবং ঠিকভাবে দেখতে পারে। অনেকের মধ্যে ভুল ধারণা আছে যে তারা কেবল রাতে দেখে, দিনে দেখতে পায় না। কিন্তু এটি সত্যি নয়। সত্যটি হল তারা রাত বা দিনে কখনই দেখতে পারে না।

তাহলে তারা এত অবাধে উড়ে বেড়ায় কীভাবে?

আসলে, তারা শব্দের প্রতিদ্ধনি ব্যবহার করে তাদের চলার পথ সন্ধান করে। তারা শব্দোত্তর ফ্রিকোয়েন্সির শব্দ তৈরি করতে এবং শুনতে পারে। শব্দোত্তর তরংগ এমন শব্দ তরংগ যা আমরা শুনতে পারি না। এই শব্দগুলি আমাদের শ্রাব্যতার পাল্লার বাইরে। মানুষের শ্রাব্যতার পাল্লা ২০ থেকে ২০০০০ হার্জ এর মধ্যে। এই সীমার কম বা বেশি শব্দ মানুষ শুনতে পায় না।

বাদুড় পথ চলার সময় এই শব্দ তৈরি করতে করতে এগিয়ে যেতে থাকে। তারপর এই শন্দ চারপাশের যে কোনও বাধায় প্রতিফলিত হয়ে ফিরে আসে। বাদুড় এই প্রতিফলিত শব্দটি শুনে বুঝতে পারে যে সামনে কোন বাধা আছে কিনা। বাধার কারণে শব্দটি যদি না ফিরে আসে তবে বাদুড় সেই নির্দিষ্ট দিকে শব্দটি শুনতে পায় না এবং বুঝতে পারে যে সেদিকে কোনও বাধা নেই। তারপরে সেই পথ ধরে এগিয়ে চলতে থাকে। এই পদ্ধতিটি ইকোলোকেশন হিসাবে পরিচিত।

অনেক ক্ষেত্রে বৈদ্যুতিক তারের অবস্থানগুলি তারা এই শব্দ দিয়ে সঠিকভাবে নির্ধারণ করতে পারে না, কারণ তারগুলি খুব চিকন থাকে। বাদুড় এমন দুটি সমান্তরাল তারের মধ্যে উড়ে যাওয়ার সময় যদি এবং একই সময়ে ধনাত্মক এবং ঋণাত্মক বৈদ্যুতিক তার স্পর্শ করে, তাহলে তৎক্ষণাৎ বিদ্যুতায়িত হয়। মানুষের বৈদ্যুতিক শক খাওয়ার মত বাদুড়ও বৈদ্যুতিক শক খেয়ে থাকে। 

জীবজন্তুতে বাদুড়ের শ্রাব্যতার সীমা সবচেয়ে বেশি। তারা প্রায় 100,000 হার্জ এর শব্দ উৎপাদন করতে এবং শুনতে পারে।


৫। পুরুষ মানুষের কন্ঠস্বর মেয়ে মানুষের কণ্ঠস্বর থেকে মোঠা হয়। 

আমরা সবাই এটি জানি, তাই না? তবে এর পেছনের কারন টি কিন্তু জানি না।

মানুষের গলায় larynx নামে একটি অঙ্গ থাকে। larynx হল আমাদের গলার ফোলা অংশ যেটি আমরা কথা বলার সময় ওঠানামা করে। এই বিশেষ অঙ্গটির দুটি পেশীকলা রয়েছে যা ভোকাল কর্ড নামে পরিচিত। হ্যাঁ, মানব দেহের চমৎকার বিষয়গুলোর মধ্যে এটিও একটি চমৎকার বিষয়। যখন আমরা কথা বলি তখন এই ভোকাল কর্ডগুলির কম্পনের ফলে শব্দ উৎপন্ন হয়। বয়স্ক পুরুষদের ভোকাল কর্ডগুলি বয়সের সাথে মোটা হতে থাকে, ফলে পুরুষ ভোকাল কর্ডগুলির কম্পাংক হ্রাস পায়। যার কারণে শব্দটি আরও গম্ভির শোনা যায়। অন্যদিকে, মহিলা বা শিশুদের মধ্যে ভোকাল কর্ডগুলির বেধ কম থাকে এবং কম্পাংক বেশি থাকে। ফলে উৎপন্ন শব্দের তীব্রতা বেড়ে যায়। এই কারণে মহিলা বা শিশুদের ক্ষেত্রে কণ্ঠ পাতলা এবং তীব্র শোনা যায়।


৬। বিদ্যুৎ চমকানোর কিছুক্ষন পরে আমরা তার গর্জন শুনতে পাই।

আমরা সকলেই বৃষ্টি বা ঝড়ের সময় বিদ্যুৎ চমকানো বা বজ্রপাত দেখেছি এবং তাদের ভয়ংকর গর্জনও শুনেছি। তবে আমরা কিন্তু ব্জ্রপাতের আলোর ঝলকানি এবং তার শব্দ একই সময়ে ঘটতে দেখি না। প্রথমে বজ্রপাত দেখি এবং কিছুক্ষণ পরে আমরা তার শব্দ শুনতে পাই।

এর কারন হল আলো এবং শব্দের বেগের পার্থক্য। আলোর বেগ শব্দের বেগের চেয়ে অনেক অনেক বেশি।

আমরা জানি, আলোর বেগ একটি ধ্রুব সংখ্যা এবং এর মান প্রতি সেকেন্ডে 300000 কিলোমিটার (প্রতি সেকেন্ডে 3 × 10 ^ 8 মিটার)। অন্যদিকে 0 ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় শব্দের গতি প্রতি সেকেন্ডে 332 মিটার। গতির এই পার্থক্যের কারণে বজ্রপাতের শব্দ বিদ্যুৎ চমকানোর একটু পরে শোনা যায়।


৭। মানুষ পূর্ন হলঘরের চেয়ে শূন্য হলঘরে শব্দের তীব্রতা বেশি।

যখন আমরা একটি খালি হল ঘরে থাকি তখন একটি ছোট্ট কোন জিনিস পরে যাওয়ার শব্দও শুনতে পাই। তবে লোক ভর্তি বা জিনিসপত্রে ভরা কোন হল ঘরে আপনি এই মৃদু শব্দগুলি আর শুনতে পাবেন না। কিন্তু কেন এমন হয়?

শব্দ সর্বদা আশেপাশের বস্তুর দ্বারা শোষিত হয়। আপনি যখন খালি হল ঘরে থাকবেন তখন আশেপাশে এমন কিছু নেই যা উৎপন্ন শব্দ শোষণের জন্য ব্যাবহৃত হতে পারে । সুতরাং, শব্দটির তীব্রতা খুব বেশি হ্রাস পায় না। এখন আপনি যদি মানুষ বা জিনিসপত্রে ভর্তি একটি হল ঘরে থাকেন তবে উৎপন্ন শব্দটি শোষণ করার জন্য অনেক কিছুই রয়েছে। ফলস্বরূপ, উৎপন্ন শব্দটির তীব্রতা হ্রাস পায় এবং আস্তে শোনা যায়।
কমেন্ট বক্সে লেখাটি সম্পর্কে আপনার মূল্যবান মতামত জানান 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

1 মন্তব্যসমূহ

If it seems any informative mistake in the post, you are cordially welcome to suggest fixing it.