আগুন পদার্থ নাকি শক্তি (What Is Fire)?

আগুন পদার্থ নাকি শক্তি?

আগুন পদার্থ নাকি শক্তি?
আগুন । Image Source: Internet

পদার্থ কাকে বলে?- সহজ কথায় যার ভর আছে, স্থান দখল করে আবার বল প্রয়োগে বাধার সৃষ্টি করে তাকেই আমরা পদার্থ বলে জানি। একটু সূক্ষ্মভাবে বললে, পদার্থ হল তাই যা অণু-পরমাণু দ্বারা গঠিত। মহাবিশ্বের একটি সামান্য অংশ এই পদার্থ দ্বারা গঠিত। আর এছাড়াও আছে বিভিন্ন রকমের শক্তি।

বিজ্ঞানীদের মতে, মহাবিশ্বের মাত্র ৫ শতাংশ পদার্থ আর শক্তি দ্বারা গঠিত। বাকি অংশ ডার্ক ম্যাটার এবং ডার্ক এনার্জি নিয়ে গঠিত। 

আবার এই ৫ শতাংশের মধ্যে যে পরিমাণ পদার্থ আছে তাদের মূলত তিনটি প্রধান ভাগে ভাগ করা যায়- কঠিন, তরল ও বায়বীয়। এদের পরিচয় নতুন করে দেবার কিছু নেই। কিন্তু যখন আমরা আগুন নিয়ে ভাবতে যাই, তখন ঠিক কূল করে উঠতে পারি না যে আগুন কোন ধরনের পদার্থ; নাকি এটি আদৌ কোন পদার্থ নয়!  

বিভিন্ন পদার্থের সাধারণ সংজ্ঞা থেকে আমরা বেশ জোড় দিয়েই বলতে পারি যে আগুন কঠিন পদার্থের মধ্যে পড়ে না। আবার এটি তরলের মধ্যেও পড়ে না। তাহলে কি আগুন গ্যাসীয় পদার্থ? এটি যদি ভেবে থাকেন তাহলে আপনি উত্তরের খুব কাছাকাছি গেছেন। কিন্তু এটিও সম্পূর্ণ সঠিক উত্তর নয়। 

আবার অনেকে পদার্থের চতুর্থ অবস্থা প্লাজমা অবস্থার কথা বলে থাকেন। কিন্তু প্লাজমা হতে গেলে এর তাপমাত্রা হতে হবে প্রায় ১০,০০০ কেলভিন। সাধারণ আগুনের তুলনায় যা অনেক অনেক বেশি। অর্থাৎ আগুনের তাপমাত্রা যদি ১০,০০০ কেলভিনের কাছাকাছি পৌঁছায় তাহলে তাকে আমরা প্লাজমা বলতে পারি,  নতুবা নয়। তাহলে দাঁড়াল যে, আগুনকে আপনি সরাসরি প্লাজমাও বলতে পারছেন না। 

এবার হয়ত ভাবতে পারেন আগুন হল শক্তি। যেমন অনেকেই আছেন যারা এরকম প্রশ্নে সরাসরি জানিয়ে দেন যে, "আগুন হল শক্তি, এটি কোনভাবেই পদার্থ হতে পারে না।" তবে আসলেই কি তাই? 

তাহলে চলুন, দেখে নেওয়া যাক আগুন নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা। এরপর নিজেই সিদ্ধান্ত নিয়ে নিতে পারবেন আসলে আগুন কি? পদার্থ নাকি শক্তি? নাকি অন্য কিছু! 


আগুন কি?

আগুন হল কোন পদার্থের দহন বিক্রিয়ার ফল। কোন বস্তুর দহনের ফলে যে তাপ ও আলোক শক্তির বিকিরণ ঘটে তাকেই আমরা আগুন হিসেবে দেখি। তাহলে আগুন কি শক্তি? না, আগুন কে শুধু শক্তি বললে ভুল হবে। আবার একে শুধু পদার্থও বলা যাবে না। মূলত এটি হল জ্বালানী পদার্থের সাথে অক্সিজেনের বিক্রিয়ায় উৎপন্ন শক্তির বহিঃপ্রকাশ। 

বিষয়টি আর একটু খোলাসা করা যাক।

অক্সিজেনের সাথে যখন অন্যান্য উপকরণের দ্রুত বিক্রিয়া ঘটে তখন প্রচুর তাপ ও আলোক শক্তি উৎপন্ন হয়ে থাকে। এ বিক্রিয়াকে দহন বিক্রিয়া বলে। আগুন বলতে মূলত এই দহন বিক্রিয়াকেই বুঝায়।

কোন জ্বালানীতে আগুন জ্বালাতে হলে তাকে নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় উত্তপ্ত করতে হবে। এই নির্দিষ্ট তাপমাত্রা কে জ্বালানী পদার্থের Ignition Temperature বলা হয়। কোন জ্বালানী যখনই তার Ignition Temperature এ পৌঁছায়, ঠিক তখনই জ্বালানীতে আগুন ধরে যায়। Ignition Temperature এ পৌঁছানোর পর জ্বালানী থেকে ক্রমাগত গ্যাস নির্গত হয়ে থাকে। 

নিচের চিত্রটি লক্ষ করুন-

আগুন জ্বলার প্রক্রিয়া । Image Sorce: sciencelearn

চিত্রটি থেকে সহজেই ধরতে পারবেন আগুন জ্বলার ধাপসমূহ। 

জ্বালানী কঠিন, তরল বা গ্যাসীয় যাই হোক না কেন, প্রচণ্ড তাপমাত্রায় এর পৃষ্ঠ থেকে গ্যাস নির্গত হতে থাকে। নির্গত গ্যাস তখন বাতাসের অক্সিজেনের সাথে বিক্রিয়া ঘটিয়ে বাষ্প ও কার্বন ডাই অক্সাইড এবং কোন কোন ক্ষেত্রে অন্যান্য পদার্থ উৎপন্ন করে থাকে। সে সাথে উৎপন্ন হয় প্রচুর তাপ যা আলো বিকিরণ করে। আর এই বিকরিত আলোকেই আমরা আগুনের শিখা হিসেবে দেখি। উৎপন্ন এই তাপ ও আলোক শক্তি আসে মূলত জ্বালানীর অভ্যন্তরীণ রাসায়নিক শক্তি থেকে।

অবিচ্ছিন্নভাবে আগুন জ্বালতে চাইলে অবিচ্ছিন্ন জ্বালানির সরবরাহ দেওয়া প্রয়োজন। যেহেতু এটি ক্রমাগত জ্বালানীর বিক্রিয়া ঘটিয়ে শক্তি নির্গত করছে এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে কার্বন ডাই অক্সাইড, বাষ্প প্রভৃতি উৎপন্ন করছে, তাই ক্রমাগত জ্বালানীর সরবরাহ না থাকলে বিক্রিয়া থেমে যাবে, যাকে আমরা আগুন নিভে যাওয়া বলে থাকি। এমনকি সূর্য - যা পারমাণবিক ফিউশন বিক্রিয়ায় তাপ এবং আলো তৈরি করে, সেটিও প্রায় চার বিলিয়ন বছরের মধ্যে তার জ্বালানী নিঃশেষ হয়ে ধ্বংস হয়ে যাবে।

দহন বিক্রিয়ার সমীকরনঃ 

জ্বালানী + অক্সিজেন + তাপ = কার্বন ডাই অক্সাইড + পানি (জলীয় বাষ্প) + তাপ

আগুনের ক্ষেত্রে যতক্ষণ পর্যন্ত জ্বালানী অবশিষ্ট থাকে, উৎপন্ন তাপ ক্রমাগত দহন বিক্রিয়া ঘটে যেতে সাহায্য করে। ফলে নির-বিচ্ছিন্নভাবে তাপ উৎপন্ন হতে থাকে যা পুনরায় দহন বিক্রিয়া ঘটে যেতে সাহায্য করে। এই কারণে আগুন কে সর্বগ্রাসী বলা হয়ে থাকে। যতক্ষণ পর্যন্ত আশেপাশে জ্বলনযোগ্য পদার্থ থাকবে ততক্ষণ পর্যন্ত আগুন জ্বলতে থাকবে। অবশ্য সে ক্ষেত্রে অক্সিজেনের সরবরাহ থাকাটা বাধ্যতামূলক। 


তাহলে সবশেষে বলা যায় যে, আগুন কোন পদার্থ বা শক্তি নয়, এটি একটি রাসায়নিক বিক্রিয়া, যে বিক্রিয়ায় বিভিন্ন উত্তপ্ত গ্যাসের মিশ্রণ থেকে ক্রমাগত তাপ ও আলো উৎপন্ন হয়।   


আগুন নিয়ে কিছু প্রশ্ন:

১। আগুন জ্বলার সময় ধোঁয়া উৎপন্ন হয় কিভাবে?

দহন বিক্রিয়া বা আগুন জ্বলার সময় আগুনের শিক্ষার সাথে আরেকটি বিষয় যেটি দৃশ্যমান হয় তা হল ধোঁয়া। দহন বিক্রিয়ায় জ্বালানীর সাথে অক্সিজেনের বিক্রিয়ার সময় বিভিন্ন ধরনের গ্যাস উৎপন্ন হয়ে থাকে। এসব গ্যাস মূলত কার্বন, হাইড্রোজেন ও অক্সিজেন দ্বারা গঠিত যৌগ। 


২। ছাই বা ভস্ম কি এবং কেন উৎপন্ন হয়?

আগুন জ্বলার পর যেটি অবশিষ্ট থাকে তা হল ছাই বা ভস্ম। আগেই বলা হয়েছে দহন বিক্রিয়ার জন্য জ্বালানী আবশ্যক। জ্বালানীর তাপমাত্রা বৃদ্ধিতেই আগুনের সূত্রপাত হয়ে থাকে এবং জ্বালানীর মধ্যে উপস্থিত কিছু পদার্থ ক্রমাগত  গ্যাসে রূপান্তরিত হয়ে অক্সিজেনের সাথে বিক্রিয়া করে থাকে। কিন্তু জ্বালানীতে উপস্থিত এরকম অনেক পদার্থ আছে যারা বিক্রিয়ায় অংশ নিতে পারে না, অর্থাৎ তাদের দহন হয় না। এই পদার্থগুলোই ছাই বা ভস্ম হিসেবে অবশিষ্ট থাকে। যেমন কাঠ পোড়ালে কাঠে উপস্থিত ক্যালসিয়াম বা পটাশিয়াম ছাই হিসেবে রয়ে যায়। বিভিন্ন জ্বালানীর ক্ষেত্রে উৎপন্ন ছাই এর ধরন জ্বালানীর উপাদানগত কারণে বিভিন্ন রকম হয়ে থাকে।  


৩। আগুনের শিখা সবসময় উপরের দিকে ওঠে কেন?

উত্তরটি দেখার জন্য ক্লিক করুন


৪। আগুনের শিখা বিভিন্ন বর্ণ বা রঙের হয় কেন?

আগুনের বর্ণ বা রং নির্ভর করে মূলত উৎপন্ন তাপমাত্রা এবং জ্বালানীর উপর। প্রথমে আসা যাক তাপমাত্রার বিষয়ে। তাপমাত্রা বৃদ্ধির সাথে সাথে আগুনের বর্ণ লাল বা কমলা থেকে নীল বর্ণ ধারণ করে থাকে। যেমন কোন আগুনের শিখা লক্ষ করলে দেখা যায় এর গোঁড়ার দিকে নীল বর্ণ। এর কারণ হল গোঁড়ার দিকে তাপমাত্রা সবচেয়ে বেশি থাকে। আবার উপরের শিখার দিকে তাপমাত্রা কমতে থাকে। তাই শিখার উপরের দিকের রং হলুদ বা কমলা হয়ে থাকে। নিচের চার্ট টি লক্ষ করুন-

বিভিন্ন রং এর আগুনের তাপমাত্রা

গাঢ় লাল: 500 to 600 °C (900 to 1,100°F) 

চাঁপা লাল: 600 to 800 °C (1,100 to 1,650°F) 

উজ্জ্বল লাল: 800 to 1,000 °C (1,650 to 1,800°F)

কমলা: 1,000 to 1,200 °C (1,800 to 2,100°F) 

উজ্জ্বল হলুদ: 1,200 to 1,400 °C (2,100 to 2,500°F) 

সাদা: 1,400 to 1,600 °C (2,500 to 2,900°F)

এর চেয়ে বেশি তাপমাত্রায় আগুন নীল বর্ণ ধারন করে। 

এবার জ্বালানীর কথায় আসা যাক। কোন জ্বালানীর যদি পূর্ণ দহন হয় তাহলে উৎপন্ন আগুনের রং হবে নীল। আবার, যদি কোন জ্বালানীর অসম্পূর্ণ দহন হয় তাহলে হলুদ বা লাল রং এর শিখা তৈরি হয়। আমরা বাসাবাড়িতে বিভিন্ন গ্যাসের চুলা ব্যাবহার করে থাকি। এল পি জি গ্যাসের চুলায় সবসময় নীল শিখা দেখা যায়। আবার যারা প্রাকৃতিক গ্যাসের চুলা ব্যাবহার করে থাকেন তারা খেয়াল করলে দেখতে পাবেন যে উৎপন্ন শিখার বর্ণ হলুদ বা কমলা। 


৫। কোথাও আগুন জ্বললে আশেপাশে কালি জমা হয় কেন? 

প্রথমেই বলা হয়েছে যে, জ্বালানীর মূল উপাদান যেটি দহনে অংশ নেয় সেটি হল কার্বন। দহনে উৎপন্ন ধোয়াতেও এর উল্লেখযোগ্য পরিমাণ উপস্থিতি থাকে। মূলত আশেপাশে কোন প্রতিবন্ধকে বা ঘরের ছাউনিতে এই কার্বন জমা হতে থাকে যাকে আমরা কালি বলি।  

কমেন্ট বক্সে লেখাটি সম্পর্কে আপনার মূল্যবান মতামত জানান 

আরও পড়ুন- পৃথিবীর ঘূর্ণনে আমরা পৃথিবী থেকে ছিটকে পড়ে যাই না কেন বা বেগ অনুভব করতে পারি না কেন?

আলোর প্রতিফলনের মাধ্যমে আমরা কিভাবে কোন বস্তু দেখতে পাই?

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

6 মন্তব্যসমূহ

  1. জিন শয়তান ধোয়াহীন আগুন থেকে তৈরি আগুন কোন পদার্থ নয় যার কারণে শয়তানকে দেখা যায় না

    উত্তরমুছুন
  2. বিদ্যুৎ এক প্রকার আগুন কিনা????

    উত্তরমুছুন
    উত্তরগুলি
    1. না, বিদ্যুৎ এক প্রকার শক্তি যা কি না ইলেক্ট্রনের প্রবাহের ফলে ঘটে।

      মুছুন
  3. বিদ্যুতের সাথে আগুনের কোন সম্পর্ক আছে কিনা???

    উত্তরমুছুন
    উত্তরগুলি
    1. হ্যা সম্পর্ক আছে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই একটি বৈদ্যুতিক প্রবাহ তাপ উৎপন্ন করবে এবং যদি এটি যথেষ্ট বেশি তাপ উৎপন্ন করে তবে এটি দহন প্রক্রিয়া শুরু করতে পারে এবং আগুন লেগে যায়। অর্থাৎ, যে কোন কিছুতে আগুন ধরতে হলে প্রচুর তাপ প্রয়োজন হয়, আর বিদ্যুৎ প্রবাহের ফলে যদি উৎপন্ন তাপের পরিমাণ অনেক বেশি হয় তবে দহন প্রক্রিয়ায় কোন বস্তুতে আগুন ধরে যাবে।

      মুছুন
  4. আপনার নাম্বারটা দেওয়া যাবে বিদ্যুত সম্পর্কে আরো ধারনা দরকার নাম্বার দিলে উপকার হবে

    উত্তরমুছুন

If it seems any informative mistake in the post, you are cordially welcome to suggest fixing it.