সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের সময় সূর্য লাল দেখায় কেন?

সূর্যোদয় বা সূর্যাস্তের সময় সূর্যকে যে কারণে লাল দেখায়  

Image by Wisilife

আমারা অনেকেই হয়তো লক্ষ করে থাকব যে দিনের বিভিন্ন সময় সূর্যকে বিভিন্ন রকম লাগে। যেমন ভোর বা সন্ধ্যার কথা বিবেচনা করলে দেখা যায় যে এ সময় সূর্যকে অধিক লাল দেখা যায়। বিশেষ করে সন্ধ্যার সময় দেখা যায় যে সূর্য রক্তিম আকার ধারণ করে। শুধু তাই নয় মাঝে মাঝে সূর্যাস্তের সময় সম্পূর্ণ আকাশকে রক্তিম বর্ণ ধারণ করতে দেখা যায়। 

তো কেন এটি ঘটে? কেন সূর্যোদয় বা সূর্যাস্তের সময় দিনের অন্যান্য সময়ের তুলনায় সূর্যকে অনেক বেশি লাল দেখায়?

আসলে এ পুরো ঘটনাটাই ঘটে আলোর বিক্ষেপণের জন্য। এক কথায়, লাল আলোর বিক্ষেপণ কম হওয়ার কারণে সূর্যোদয় এবং সূর্যাস্তের সময় সূর্যকে এমন লাল দেখায়। 

আর বিস্তারিত ভাবে জানতে চাইলে আমাদের আগে জানতে হবে আলোর বিক্ষেপণ কি!

যখন কোন আলোক তরঙ্গ এর যাত্রাপথে কোন ক্ষুদ্র কণার ওপর পড়ে, তখন ক্ষুদ্র কণাগুলো আলোক তরঙ্গকে বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে দেয়। আলোক তরঙ্গ কে চারদিকে ছড়িয়ে দেওয়ার এই ঘটনাকে বলা হয় আলোর বিক্ষেপণ। 

একটি উদাহরণ বিবেচনা করা যেতে পারে। ধরুন, আপনি একটি পানি ভর্তি প্রশস্ত একটি পাত্র নিয়েছেন। এবার পানির মধ্যে কয়েকটি ছোট ছোট বল রাখুন (পানিতে অবশ্যই ভাসতে হবে)। তারপর পানির পৃষ্ঠে সামান্য আঘাত করে হাল্কা ঢেউ এর সৃষ্টি করুন। দেখা যাবে যে আপনার আঘাতে পানির পৃষ্ঠে সৃষ্ট ঢেউ চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে। একই সাথে আপনার রাখা বলগুলোতে ঢেউ বাধাপ্রাপ্ত হয়ে পুনরায় অন্য দিকে ঢেউ সৃষ্টি করছে। অর্থাৎ আপনার রাখা বলগুলো আপনার উৎপন্ন করা ঢেউ কে পুনরায় চারদিকে ছড়িয়ে দিচ্ছে। 

আলোর বিক্ষেপণ কেও প্রায় একইভাবে কল্পনা করতে পারেন। যেমন আপনার ঢেউ উৎপন্ন করার স্থানটিকে সূর্যের অবস্থান বিবেচনা করতে পারেন। আর বলের জায়গায় কল্পনা করতে পারেন আমাদের বায়ুমণ্ডলে থাকা বিভিন্ন গ্যাসের কণা। 

সূর্যের আলো যখন পৃথিবীতে আসে তখন আমাদের বায়ুমণ্ডলে বিভিন্ন গ্যাসের সাথে এর সংঘর্ষ ঘটে থাকে। সূর্যের এই আলোক তরঙ্গকে বায়ুমণ্ডলে থাকা বিভিন্ন গ্যাসীয় অণু চারদিকে ছড়িয়ে দেয়। 

এখন প্রশ্ন হল এই বিক্ষেপণের সাথে লাল রঙ এর সম্পর্ক কি? 

আমরা জানি সূর্যের আলো হল সাত রঙ এর সমষ্টি। অর্থাৎ সূর্যের আলোকে বিশ্লেষণ করলে সাতটি রঙ পাওয়া যাবে যেমনটা আমরা রংধনু তে দেখে থাকি।   

মূলত সকল তরঙ্গেরই একটি নির্দিষ্ট তরঙ্গদৈর্ঘ্য থাকে। দৃশ্যমান আলোরও একটি নির্দিষ্ট তরঙ্গদৈর্ঘ্যের সীমা আছে। আমরা সাধারণত ৪০০-৭০০ ন্যানো মিটার তরঙ্গদৈর্ঘ্যের তরঙ্গ দেখতে পাই এবং এই দৃশ্যমান আলোর মধ্যে তরঙ্গদৈর্ঘ্যের ভিন্নতার জন্য আমরা বিভিন্ন রঙ এর আলো দেখে থাকি।

দৃশ্যমান আলোর এই বিভিন্ন রঙ এর আলো সমূহকে তাদের তরঙ্গদৈর্ঘ্য অনুসারে সাজালে যে ক্রমটি হয় তা হল- 

- বেগুনী 

- নীল 

- আসমানি 

- সবুজ 

- হলুদ 

- কমলা 

- লাল

অর্থাৎ, নীল আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য সবচেয়ে কম এবং লাল আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য সবচেয়ে বেশি। যে আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য যত বেশি তার বিক্ষেপণ তত কম হয় আবার যার তরঙ্গদৈর্ঘ্য যত কম তার বিক্ষেপণ তত বেশি। যেহেতু নীল আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য সবচেয়ে কম তাই এটি সবচেয়ে বেশি বিক্ষেপিত হয় এবং লাল আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য সবচেয়ে বেশি বলে তা সবচেয়ে কম বিক্ষেপিত হয়। আবার নীল আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য কম হওয়ার জন্য আমরা আকাশকে নীল দেখে থাকি।  

সূর্যোদয় এবং সূর্যাস্তের সময় সূর্য প্রায় দিগন্তরেখার কাছাকাছি থাকে এবং সূর্যালোক আমাদের চোখে পৌঁছুতে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের পুরু স্তর ভেদ করে আসতে হয়। ফলে আলোকরশ্মিকে বায়ুমণ্ডলের মধ্য দিয়ে যাওয়ার সময় দিনের অন্যান্য সময়ের তুলনায় সূর্যোদয় এবং সূর্যাস্তের সময় অধিক দুরত্ব অতিক্রম করতে হয়। 

এতে করে আলোক রশ্মিকে অন্যান্য সময়ের তুলনায় ভাসমান ধূলিকণা, পানি-কণার সাথে অধিক সংঘর্ষে পড়তে হয়। এই সংঘর্ষের কারণে আলোর বিক্ষেপণ হতে শুরু করে। নীল প্রান্তের কম তরঙ্গদৈর্ঘ্যবিশিষ্ট বর্ণগুলো অধিক বিক্ষেপিত হতে থাকে (যেহেতু তরঙ্গদৈর্ঘ্য কম), কিন্তু লাল প্রান্তের আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য বেশি হওয়ায় তা কম বিক্ষেপিত হয়। এতে করে লাল আলো চারদিকে ছড়িয়ে না পড়ে সরাসরি চলে আসে। ফলে সূর্যালোক যখন এই দীর্ঘ বায়ুমণ্ডল পাড়ি দিয়ে আমাদের চোখে আসে তখন লাল আলোই সবচেয়ে বেশি পরিমাণে আসতে পারে। যার ফলাফল হিসেবে আমরা সূর্যাস্ত ও সূর্যোদয়ের সময়ে সূর্যকে দিনের অন্যান্য সময়ের তুলনায় অধিক লাল দেখি। 

কমেন্ট বক্সে লেখাটি সম্পর্কে আপনার মূল্যবান মতামত জানান 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ